ডাস্টবিনে আর কত নবজাতক!
সেটাই ঠিক যে, মানবতা এখন হটকেক! করপোরেট বাণিজ্যের অন্য এক মুনাফা! বিশ্বজুড়ে শত শত এনজিও মানবতা নিয়ে চিল্লাচিল্লি করছে। কেউ বলছেন পৃথিবী এগিয়ে যাচ্ছে। কেউ বলছেন মানবতার জয় হয়েছে। কিন্তু চারপাশটা তো দেখি আমরা সবসময়ই ঘোলা চশমায়। বলা যায় অন্যের চোখে। কেননা, চোখ যে বিকিয়ে দিয়েছি কীটপতঙ্গের বেঁচে থাকার দামে!
মনে পড়ে, ১৯৯৩ সালের দুর্ভিক্ষ-পীড়িত, দাঙ্গা-বিক্ষুব্ধ দক্ষিণ সুদানের কথা। সেই সঙ্গে চোখে ভেসে ওঠে কেভিন কার্টারের তোলা ‘স্ট্রাগলিং গার্ল’ ছবিটি। মৃতপ্রায় হাড় সর্বস্ব ক্ষুধার্ত একটি কন্যাশিশু হামাগুড়ি দিয়ে যাওয়ার চেষ্টা করছে আশ্রয় কেন্দ্রের দিকে। তার ঠিক পেছনেই ওঁত পেতে বসে আছে এক ক্ষুধার্ত শকুন। দুজনেই বুভুক্ষু। শিশুটি খাদ্যের সন্ধানে যাচ্ছে আশ্রয় শিবিরে। আর শকুনটি অপেক্ষা করছে শিশুটিকে খাবার বানাতে।
নিউইয়র্ক টাইমসে ছবিটি প্রকাশের পর বিশ্বসেরা সব পত্রিকায় ঠাঁই পায় ছবিটি। কেভিনও জিতে নেন সাংবাদিকতার সেরা পুরস্কার পুলিৎজার।
কাহিনি কিন্তু এখানেই শেষ হতে পারতো। কিন্তু না, মানবতার অভিশাপে খুন হয়েছেন কেভিন। তিনি যে শুধু পেশাগত দায়িত্ব পালনই করেছেন, প্রাণে তো বাঁচাতে পারতেন শিশুটিকে। তাই, কোটি টাকার প্রশ্ন চলে আসে সামনে। একজন সাংবাদিক কি শুধুমাত্র তথ্য বা সংবাদচিত্র দিয়েই ক্ষান্ত হবেন? না কি ঘটনায় একাত্ম হয়ে দেখাবেন মানবিকতাও?
তুমুল সমালোচনা আর দুর্ভিক্ষের ভয়াবহতা দেখে তীব্র মানসিক অবসাদে কেভিন কিন্তু শেষ অবধি বেছে নিয়েছিলেন আত্মহত্যাকে। বলা যেতে পারে, কেভিনের মানবতাবোধের যন্ত্রণা দৃষ্টান্ত হয়ে থাকবে।
যে ঘটনা নিয়ে লেখাটা শুরু তা এতোবড় দৃষ্টান্তের সঙ্গে যায় কি না তা ভেবে দেখিনি। ময়লার স্তূপে ছুঁড়ে ফেলা একটা নবজাতকের ডান হাত ছিঁড়ে খেয়ে ফেলছে এক ‘পাষণ্ড’ কুকুর। সে দৃশ্যটি ক্যামেরাবন্দি করেছেন এক সাংবাদিক। যিনি কুকুর তাড়ানোর আগে ছবি তোলাকেই দিয়েছিন বেশি গুরুত্ব। অবশ্য, পরে তিনি কুকুরটি সরিয়ে দিয়েছিলেন কিনা তা জানা যায়নি। এমন একটা দৃশ্য দেখে কেভিন কার্টারের কথাই যে মনে পড়বে তা তো আগে থেকে জানিনে।
আমাদের দেশে পথেঘাটে প্রায়শই চোখে পড়ে অনাকাঙ্ক্ষিত নবজাতকের লাশ। কখনও কুকুর টানাটানি করছে। কখনও বা পচে গলে যাওয়া ক্ষুদ্র শরীর। কখনও আবার গহীন জঙ্গল থেকে ভেসে আসে নবজাতকের কান্নার ধ্বনি। কখনও বাড়ির ময়লা ফেলার ডাস্টবিনে দেখা মেলে পলিথিনে পেঁচানো দু’একটি জীবন্ত বা মৃত নবজাতকের।
এসব দেখে মনে হয়, নবজাতকরা হয়তো মানুষের পর্যায়ে পড়ে না! বাংলা ব্যাকরণে তো এদের সর্বনাম ব্যবহার করা হয় ইতর বিশেষের সঙ্গে মিল রেখে।
সেই ঘটনাটা শুক্রবার (১২ ফেব্রুয়ারি) রাতের। লক্ষ্মীপুর সদর হাসপাতালের ময়লার স্তূপে ফেলে দেয়া হয়েছিল এক নবজাতকের মরদেহ। ‘পাষণ্ড’ কুকুর ওই বাচ্চাটির ডান হাত ছিঁড়ে খেয়ে ফেলেছে। এর পেছনের ঘটনা হচ্ছে, হাসপাতালের দুই সেবিকা (!) মিলে বাচ্চাটিকে দাফন করার নাম করে টাকা হাতিয়ে নেয়। এরপর কে রাখে কার খবর? তাই তো চোখ ফাঁকি দিয়ে নবজাতককে ছুঁড়ে ফেলা হয় ময়লার স্তূপে।
আগেরদিন ১১ ফেব্রুয়ারি রাতে লায়লা বেগম নামে এক নারীর প্রসব বেদনা উঠলে তাকে ভর্তি করানো হয় সেই লক্ষ্মীপুর সদর হাসপাতালে। পরদিন ১২ ফেব্রুয়ারি বেলা ১১টায় মৃতসন্তান জন্ম দেন ওই প্রসূতি। সন্তানের বাবা মৃত নবজাতককে বাড়ি নিয়ে আসতে চান দাফনের জন্য। কিন্তু হাসপাতালে কর্তব্যরত সেই দুই সেবিকা বাচ্চাকে নিজেরা দাফন করার নাম করে দম্পতির কাছ থেকে টাকা আদায় করেন। পরের ঘটনা নিয়ে মানবিকতা আর অমানবিকতার সীমারেখা নির্ণয়ে কালক্ষেপন করা যেতে পারে।
আগেই বলেছিলাম, আমরা অন্যের চোখে দেখি। সেবিকা হয়ে নবজাতককে এভাবে ডাস্টবিনে ফেলে দিয়ে কুকুর-শিয়ালের খাদ্য বানাবার কৌশল বোধ হয় বেশিই চর্চা করি আমরা। এসব ঘটনা নিয়ে আমরা অন্তত নির্বিকার। যদি কোনো এক কেভিন কার্টার আসতেন, নবজাতকের ডান হাতে ছিঁড়ে খাওয়ার ছবি বিশ্বমিডিয়ায় দিতেন, তাহলে আমরাও ‘লাইমলাইটে’ চলে আসতাম।
কিন্তু দুঃখজনক ঘটনা হচ্ছে কেভিন মারা গেছেন। আর কোনো কেভিনও হয়তো জন্ম নেবে না এমন দেশে। কারণ নিজের জন্মদিনের শুভেচ্ছার ডালি পেতে পরের জন্মদিন হয়তা এসে যেতো। আর এর মধ্যে যতো নবজাতক পৃথিবীর মুখ দেখতো, তাদের দিকে ফিরে তাকাবার সময়ই হয়তো হতো না কেভিনের।
আগেই বলেছি, আমরা এগিয়ে যাচ্ছি, বদলে যাচ্ছি। এখন তো প্রতি ঘরে ঘরেই উৎসব করে কাটা হয় জন্মদিনের কেক। হ্যাপি বার্থ ডে টু ইউ বলে মুখর হই প্রতিদিনই। হয়তো এমনি উৎসবের মধ্যেও কানে ভেসে আসতে পারে কোনো এক অনাকাঙ্ক্ষিত নবজাতকের কান্না। কিংবা উদ্ধার হতে পারে তার মৃতদেহ, কিংবা কুকুরে টানাটানি করা নবজাতকের ছিন্নভিন্ন শরীর। এসব নবজাতকের বার্থ ডে কিন্তু হ্যাপি না। এরা কেউই হয়ে উঠতে পারে না কেভিনের ‘স্ট্রাগলিং গার্ল’!
কোন মন্তব্য নেই:
একটি মন্তব্য পোস্ট করুন